তালাশ তালুকদার
মডার্ন টাইমস মুভি নিয়ে কিছু বলার আগে চার্লি চ্যাপলিন নিয়ে বলার দরকার পড়ে। বিশেষত এই মুভি দেখার পরে আপনার মনে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, চার্লি চ্যাপলিন আসলে কোন পক্ষের লোক। মানে, গোটা বিশ্বে যে দুইটা বহুল মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে আছে, কমিউনিজম বনাম ক্যাপিটালিজম। এই কমিউনিজম ও ক্যাপিটালিজমের কোন পক্ষকে প্রেজেন্ট করেছে?

নেট থেকে সংগৃহিত।
প্রথমে অনেকের মনে হতে পারে চ্যাপলিন পুঁজিবাদের বিরোধীতা করেছে কিন্তু সূক্ষ্মভাবে বিচার বিশ্লেষন করলে দেখা যাবে যে, চ্যাপলিন পুঁজিবাদের পক্ষেই তার অবস্থান খুব সুকৌশলে ধরে রেখেছে। মডার্ন টাইমস মুভিতে চ্যাপলিন যেভাবে একজন কম্যুনিষ্টকে ভাগ্য বিড়ম্বিত কিংবা পলায়নপর মানুষ হিসেবে দেখিয়েছে তাতে করে এটা সহজেই অনুমেয় হয়। এবং এই মুভি শেষ পর্যন্ত দেখলে বুঝবেন যে, কোনোভাবেই একজন কম্যুনিষ্টকে সমাজ কিংবা রাষ্ট্র সুরক্ষা দিতে চায়না কিংবা দেওয়ার চেষ্টা করেনা।একারণে দেখবেন চার্লি চ্যাপলিন ও পলেটা গডার্ড বারবার ক্যাপিটালিস্ট সোসাইটি থেকে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে শেষে চলেই যেতে বাধ্য হয় অজানার উদ্দেশ্যে।
উৎকৃষ্ট সভ্যতার জন্য পুঁশিবাদীরাই মানানসই বাকিরা অর্থ্যাৎ যারা কিনা শ্রমিকশ্রেনী তারা বেমানান। একারণে দেখবেন, চ্যাপলিন নাট টাইট দিতে দিতে ভজঘট পাকিয়ে ফেলছে। ভজঘট পাকানোর জন্য দোষ দিচ্ছে শ্রমিককে। ফলে শ্রমিক তিরস্কৃত হচ্ছে, অপমানিতও হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো শ্রমিক কেন ভজঘট পাকাচ্ছে? পুঁজিপতিরা যখন স্বাভাবিক গতিতে ঘোরা যন্ত্রটা অধিক উৎপাদনের আশায় দ্রুত ঘোরাচ্ছে তখনই উৎপাদন ক্ষেত্রে ভজঘট পাকিয়ে ফেলছে শ্রমিক। কেননা, শ্রমিক তো আর যন্ত্র নয় যে যন্ত্রের মত অস্বাভাবিক গতিতে ঘুরতে পারবে। কিন্তু একথা আর কেহ বলেনা, দোষ হয় শ্রমিকের। ফলে অযোগ্যভাবে শ্রমিককে সমাজে উপস্থাপন করা হয়।পরাজিত মানুষ হিসেবে শ্রমিককে দেখানো হয়। যে পরাজিত মানুষকে নিয়ে আবার ঠাট্টা, ব্যঙ্গ বিদ্রুপও করা যায়। যখন একজন কম্যুনিষ্টের পরাজিত মুখচ্ছবি আঁকা হয় তখন পুঁজিবাদই উৎকৃষ্ট, উত্তমরূপে সমাজের কাছে ফুটে উঠে। চ্যাপলিন সেটাই এই ম্যুভিতে করেছে।
কমিউনিজম যেন বহুল চর্চিত বিষয় না হতে পারে তার জন্য চ্যাপলিন এমনভাবে এই মুভিতে শ্রমিককে দেখায় যা সত্যি সত্যিই ভয়ংকর এবং সঙ্গে সঙ্গে প্যাথেটিকও বটে। এখানে একজন শ্রমিককে অসুস্থ্য বলে চালিয়ে দেয় এবং পরক্ষণে সমাজ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে। চ্যাপলিন ঐ শ্রমিককে এতদূর পর্যন্ত নিয়ে এসেই ক্ষেন্ত হননি। আরো ভয়াবহভাবে দেখাইছেন, তাহলো, ঐ শ্রমিককে শ্রমিক আন্দোলনের মিথ্যা অভিযোগ এনে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দিয়ে জেল পর্যন্ত খাটিয়ে নিয়েছেন। অর্থ্যাৎ, পুরা মুভিতে একজন শ্রমিককে নাকানিচুবানি দেওয়ার জন্য যা যা করা দরকার হয় তাই তাই করেছেন। শ্রমিককে এভাবে দেখানোর ফলে নিশ্চিতভাবে অপরপক্ষকে শক্তিশালীভাবে হাজির করা হয়েছে।

এই মুভিতে দেখা যায় ভাগ্যবিড়ম্বিত চ্যাপলিনের মতই তার প্রেমিকা পলেটাও ভাগ্যবিড়ম্বিতা। যে রুটি রুচির অপরাধে পুলিশের কাছে ধরা খায়। অজানা, অচেনা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চ্যাপলিন তখন মেয়েটিকে বাঁচাতে পুলিশকে বলে যে, রুটিটা চ্যাপলিনই চুরি করেছে। পলেটার প্রতি চ্যাপলিনের এই দরদ মূলত আমাদেরকে ভালভাবে শ্রেনীচেতনা নামক জিনিসটি বুঝিয়ে দেয়, যে শ্রেনীর সে সে শ্রেনীর! কিন্তু বাস্তবতা আসলেই কি তাই? প্রত্যেকের পারিবারিক জীবন, প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবন, এবং প্রত্যেকের রাজনৈতিক জীবন আলাদা আলাদা হওয়ার কথা। কিন্তু এই জিনিসটা কাঠামোবাদীরাও মানতে চাননা। চ্যাপলিনও মানতে চাননি বলেই একপেশেভাবে অর্থ্যাৎ একই শ্রেনীর ভেতরে প্রেম দেখানোটাকে ম্যান্ডেটরি বলে মনে করেছে।
এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যযোগ্য যে, পুঁজিপতি বাদে সবাই এখানে শ্রমিক। এখানে প্রত্যেকেই ঘড়ি ধরে সকালে ভেড়ার মত (মুভিতে দেখানো হয়েছে) খোয়াড়ে ঢোকায়, লাঞ্চ টাইম হলে লাঞ্চ করে, ইভেনিং টাইমে বের করা হয়। এইভাবে চলতে চলতে একটা সময়ে মানুষ কাজের সঙ্গে এমনভাবে ইনভলব হয়ে যায় যে, সে কাজের দাস হয়ে যায়। কাজ থেকে ছুটি হলেও সে হাটতে ফিরতে, চলতে খেতে সব সময়ই ঐ কাজই সে করার অভ্যাসে করতে থাকে। মানে, যন্ত্র যে মানুষকে রোবট করে ফেলেছে, মডার্ন টাইমসে চ্যাপলিন তা দেখিয়ে দিয়েছে।
পাশাপাশি এইটাও দেখাইছে যে, ক্যাপিটাল মানুষকে একটা সংখ্যামাত্র মনে করে। এইখানে মানুষের আবেগ নাই, ভালবাসা নাই। ভালবাসা আছে কিন্তু সে ভালবাসা সিস্টেমেটিক। একজন মানুষ মেশিনের ভিতর আটকে যাওয়ার পরও মানুষটাকে উদ্ধার না করে তারা প্রত্যেকে লাঞ্চ করতেছে। আবার মেশিনের ভিতর আটকে যাওয়া মানুষটাকে উদ্ধারের পরিবর্তে তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করা হইতেছে। এইটা কম্যুনিস্টদের সাথে নিছক মসকরা করার সমতুল্য।
আমার কেন জানি মনে হইছে, চ্যাপলিন পুঁজিপতিদের ভ্যানগার্ড হিসেবে দাঁড়িয়েছে। যদিও অনেক কিছুই সাদাচোখে মনে হতে পারে, আরে এটাতো পুঁজিবাদ জিনিসটাকে ধুয়ে দিয়েছে। কিন্তু পরোক্ষভাবে কমিউনিজমকে কখনো পলায়নপরতা, কখনো ভয়ংকরতায় কখনো পরাজিত মানুষের ছবি হিসেবেই হাজির করেছে।

আরেকটা কথা, পুঁজিবাদীরা ভোগবাদী। কিন্তু কোনো পন্য ভোগ করার আগে সে পন্য কোনো না কোনো শ্রমিককে দিয়ে পরীক্ষা করায়। পুঁজিবাদীরা মনে করে শুধুমাত্র তাদের প্রাণেরই মূল্য আছে, শ্রমিকদের নাই। ফলে, কোনো পন্যের ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলে সেটার সাফারার শ্রমিককেই হতে হয়। এই মুভিতেও সেটাই দেখানো হলো।
মোট কথা, আমার কেন জানি মনে হইছে, চ্যাপলিন পুঁজিপতিদের ভ্যানগার্ড হিসেবে দাঁড়িয়েছে। যদিও অনেক কিছুই সাদাচোখে মনে হতে পারে, আরে এটাতো পুঁজিবাদ জিনিসটাকে ধুয়ে দিয়েছে। কিন্তু পরোক্ষভাবে কমিউনিজমকে কখনো পলায়নপরতা, কখনো ভয়ংকরতায় কখনো পরাজিত মানুষের ছবি হিসেবেই হাজির করেছে।

Leave a Reply