রাইফেল, রোটি, আওরাত: রক্তবীজের উপাখ্যান ।। আফরোজা সোমা

কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে, মুক্তিযুদ্ধের উপরে লেখা একটি মাত্র বইও যদি কেউ পড়তে চায় বা কাউকে পড়তে হয়, তাহলে আপনি কোন বইটি পড়তে বলবেন?
আমি বলবো, ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’।

কেন এই বই?

কারণ আমার বিবেচনায় এরচে’ অথেনটিক, এরচে’ প্রাঞ্জল, এরচে’ র, এরচে’ বেশি আবেগের দলিল, এরচে’ বেশি প্রামাণ্য মুক্তিযুদ্ধের আর কোনো উপন্যাস নয়।

এটিকে মূলত ডকুফিকশন বলাটাই ন্যায্য, শুধু উপন্যাস নয়।


শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার লেখা এই উপন্যাসটিই মুক্তিযুদ্ধের উপরে লেখা প্রথম উপন্যাস। দেশ স্বাধীন হবার আগেই, অবরুদ্ধ দেশে থেকেই তিনি উপন্যাসের শেষ লাইনে নিশ্চিতভাবেই বলেছেন, স্বাধীনতা ঐ আসছে! মা ভৈ!


এর রচয়িতা আনোয়ার পাশা। তিনি পেশায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার লেখা এই উপন্যাসটিই মুক্তিযুদ্ধের উপরে লেখা প্রথম উপন্যাস।
দেশ স্বাধীন হবার আগেই, অবরুদ্ধ দেশে থেকেই তিনি উপন্যাসের শেষ লাইনে নিশ্চিতভাবেই বলেছেন, স্বাধীনতা ঐ আসছে! মা ভৈ!
অবশ্য, স্বাধীনতা তিনি নিজের চোখে দেখে যেতে পারেননি।

১৪ই ডিসেম্বরে নিজের বাড়িতে পাশা সকালে নাশতা করছিলেন। সেখান থেকে তাকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তার লাশ পাওয়া যায় মিরপুরের বধ্যভূমিতে।

একটি বইই কী করে মানুষের বুকের ভেতর একটি দূর্গ গড়ে দিতে পারে, তার প্রমাণ এই উপন্যাস আর সেই দূর্গ গড়ার স্বাক্ষী আমি নিজে।

ইতোমধ্যেই অন্তত কয়েকশ’ তরুণ-তরুণীকে এই গ্রন্থ পাঠ করিয়েছি। সেটা অবশ্য ভিন্ন গল্প।
সুদীপ্ত শাহীন নামের প্রধান চরিত্রের ভেতর দিয়ে এই উপন্যাসে আদতে আনোয়ার পাশা নিজেই হাজির থেকেছেন।

রক্ত, মৃত্যু, ধর্ষণ, সহিংসতা, বিশ্বাসঘাতকতা, নির্যাতন-নিপীড়নের বয়ান কতটা জীবন্ত হতে পারে, ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ তার নির্মেদ, নির্মোহ উদাহরণ।

ধর্ম, ভাষা ও রাজনীতিকে কী করে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘রাইফেল, রোটি আওরাত’ সেই বয়ানও ছত্রে ছত্রে হাজির করেছে।

অনেক রক্ত, অনেক মৃত্যু দেখে ট্রমাক্রান্ত সুদীপ্তের মনোজগৎ ছিলো হতবিহবল, নাজুক, ঘোরগ্রস্ত।

২৫শে মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যার পর লুকিয়ে থেকে কোনো মতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া সুদীপ্ত তার সঙ্গী, সাথী, সহকর্মীদের লাশের উপর দিয়ে পালিয়ে নিরাপদ আশ্র‍য়ের খোঁজে উদ্বাস্তু হয়।
খুঁজতে খুঁজতে পায়ও একটা সাময়িক নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু সেই নিরাপত্তার ভেতরেও কুঁকড়ে ওঠে সুদীপ্ত।

ভর দুপুরের রোদ ঝলমল আলোয় প্রস্ফুটিত রক্তজবা ফুল দেখে সুদীপ্তের বিভ্রম হয়।

তার মনে হয় যেনো-বা গাছের মধ্যে ঝুলে আছে কারোর বুলেটবিদ্ধ রক্তাক্ত অঙ্গ।

চিত্রশিল্পী আমান, তার স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গিয়ে যৌনদাসী / সেক্সস্লেভ হিসেবে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে আটকে রাখার কাহিনী আপনার লোমকূপে শীতল শিরশিরানি এনে দেবে; এনে দেবে রাগ, ক্ষোভ ও বেদনার অদ্ভুত মিশেল।


এই বইয়ের পাণ্ডুলিপিটা বাঁচাতেও অনেক কসরত করতে হয়েছে আনোয়ার পাশার স্ত্রীকে। পান্ডুলিপিটিকে মিটসেফের ভেতরে হাঁড়িকুড়ি রাখার জায়গায় বিছিয়ে দিয়ে তার উপরে কাগজ বিছিয়ে হাড়ি-পাতিল রাখতেন তিনি।


বাংলা নাম দেখলেই সেটিকে ‘হিন্দুয়ানী’ বলে ধর্মের ‘ট্যাগ’ মেরে দেওয়া এবং যা কিছু বাংলা ও বাঙালির নিজস্বতা, সেগুলোকে হিন্দুয়ানী ছাপ্পর মেরে খারিজ করার সংস্কৃতি আজকের নয়, তখনকার। এই আইডিয়া ও বয়ানগুলো সেইসময় থেকেই পাকিস্তানপন্থীদের হাতিয়ার।
কিন্তু গাছ কেটে ফেললেই কি আর বসন্তের আগমনকে প্রতিহত করা যায়! যায় না।

শূন্য দিগন্তে বসন্তের বায়ু এমন ঘ্রাণ নিয়ে বইতে থাকে যে, তারচে’ বরং ফুলেল বসন্তের ‘অত্যাচার’ বরং কম মনে হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও সেরকম হয়েছে।

আনোয়ার পাশা উপন্যাসে লিখছেন, “বাঙালিরা এখন মরতে শিখেছে, অতএব তাকে মেরে নিঃশেষ করে দেবার ক্ষমতা এখন পৃথিবীতে কারো নেই”।

এই বইয়ের পাণ্ডুলিপিটা বাঁচাতেও অনেক কসরত করতে হয়েছে আনোয়ার পাশার স্ত্রীকে।
পান্ডুলিপিটিকে মিটসেফের ভেতরে হাঁড়িকুড়ি রাখার জায়গায় বিছিয়ে দিয়ে তার উপরে কাগজ বিছিয়ে হাড়ি-পাতিল রাখতেন তিনি।

যদি রেইড দিতে এসে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা কোনোদিন ঘরে ঢুকে খোঁজাখোঁজি শুরু করে তখন যেনো পাণ্ডুলিপিটা খোয়া না যায়, তাই এতো কসরত করতে হয়েছে বলে ভয়েস অফ আমেরিকাকে এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন আনোয়ার পাশার কনিষ্ঠ পুত্র।

আনোয়ার পাশা স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু তিনি যে দিব্যদৃষ্টিতে দেখে লিখেছিলেন, “নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভা। সে আর কত দূর। বেশি দূর হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো। মা ভৈঃ। কেটে যাবে।” তা সত্য হয়েছিলো।

জাতী এবং দেশ আদতে শুরু হয় একটা কল্পিত সমাজ বা ‘ইমাজিন্ড কমিউনিটি’ হিসেবে।
ক্রমে তার বাস্তব রূপ প্রস্ফুটিত হয়।

দেশ তথা জাতি আবার একটা রিলে রেসের মতন ব্যাপারও বটে।

৪০০ মিটার দৌড়ে একজন গিয়ে দৌড়ে পরের জনের কাছে ব্যাটনটা পৌঁছে দেয়। সেখান থেকেই শুরু হয় তার পরের জনের দৌড়। আপাতার্থে, দুইজন ভিন্ন মানুষের দৌড় হলেও তারা একই সূত্রে গাঁথা।

আমি কেন ১৮ কি ২০/২২ এর তরুণ-তরুণীদেরকে ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ পড়তে দিতে ব্যাকুল হয়ে থাকি?

আনোয়ার পাশা আমার বুকের ভেতরে প্রস্ফুটিত টুকটুকে লাল অথচ ব্যথিত যে রক্তজবা গুঁযে দিয়ে গেছেন, সেই জবা তো আর আমি বা আমার মতন ক’জনের জন্য কেবল নয়! এই জবা আদতে রক্তবীজ! একে রক্তের ফোঁটার মতন আরো আরো বুকের জমিনে রুইয়ে দেওয়াই পবিত্র কর্তব্য।


আফরোজা সোমা
কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক।

বাংলাদেশের জ্ঞানকান্ডের ধ্বংস প্রক্রিয়া।। ইরফান শেখ

সুগৃহিণী ।। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

Leave a Reply