ওমর আলীর কয়েকটা কবিতা

ওমর আলী জন্মছিলেন পাবনা জেলাতে। তার জন্মতারিখ ২০ অক্টোবর ১৯৩৯ সাল আর মৃত্যু হয়েছে ৩ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে।

ওমর আলী তাঁর লেখালেখি জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটে দিয়েছেন গ্রামে বসবাস করে।

তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। এই বইটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই তার ডাকনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে সাহিত্যামহলে।

এরপর ধীরে ধীরে তার লেখার গতি বাড়তেই থাকে ঝড়ের বেগে। কবিতার পাশাপাশি কুতুবপুরের হাসনা হেনা এবং খান ম্যানসনের মেয়ে নামে দুইটা উপন্যাসও লিখেছেন।

এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি আরো কয়েকটা উল্লেখযোগ্য কবিতার বই হলো, আত্মার দিকে, প্রস্তর যুগ তাম্র যুগ, স্থায়ী দুর্ভিক্ষ সম্ভাব্য প্লাবন, ডাকছে সংসার, যে তুমি আড়ালে, ফেরার সময়, লুবনা বেগম, প্রসারিত করতল, এখনো তাকিয়ে আছি, গ্রামে ফিরে যাই, আমার ভেতরে খুব ভাঙচুর হচ্ছে সহ ৩০টির মতো কবিতাবই।

তিনি পুরস্কার পেয়েছেন, বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), বন্দে আলী মিয়া পুরস্কার (১৯৮৮), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১), একুশে পদক (মরণত্তর) (২০১৭)।

অব্যয়ের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো ওমর আলীর ১০টি কবিতা।


আমি স্বাধীন

আমি স্বাধীন হরিয়াল টুনটুনি ডাহুক ও দোয়েলের মতো
সারা দিন মাঠে মাঠে ঘুড়ি উড়াই আর খরগোসের ছানা ধরে আনি
ডানাঅলা স্বর্গের চেরাব আমি নিজ ইচ্ছা বেড়ায় নিরত
আমার ভাবনা চিন্তা কিছু নেই গলা ছেড়ে গান গাইতে জানি
অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে দড়ি বেঁধে ত্রিভুজ ঠেলা জালেও মাছ ধরি
খুব ভাল দেখে বেছে ইক্ষু ভেঙ্গে আলপথে বসে খেতে থাকি
হয়তো অনেক দুর গান গেয়ে একা একা বেয়ে যাই তরী
আহ! কি আরাম আমি স্বাধীন মাছরাঙা বক বুলবুলি পাখি
জলাশয়ে নেমে গিয়ে যত খুশি ডুব দিই গ্রীষ্মের দুপুরে
পাকা পাকা কুল পাড়ি ঢিঁল ছুঁড়ে লবনে সুস্বাদু করে খাই
সারাটি গ্রামের মধ্যে একাকী বা ছেলেদের সাথে বেড়াই ঘুরে
হঠাৎ ইচ্ছে হলে তিন গ্রামের পরে মামা বাড়ি চলে যাই
আমার সংসার নেই সংসারের চিন্তা নেই রোগ দুঃখ নেই
খাই ও ঘুমাই আমি আরামে বিছানা পেয়ে যাই একটা যেই…

 

এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি

এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি
আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা;
সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে,
রুপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা ।

সে শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে হরিণীর মতো
মায়াবী উচ্ছ্বাস দুটি চোখ, তার সমস্ত শরীরে
এদেশেরই কোন এক নদীর জোয়ার বাঁধভাঙা;
হালকা লতার মতো শাড়ি তার দেহ থাকে ঘিরে ।

সে চায় ভালোবাসার উপহার সন্তানের মুখ,
এক হাতে আঁতুড়ে শিশু, অন্য হাতে রান্নার উনুন,
সে তার সংসার খুব মনে-প্রাণে পছন্দ করেছে;
ঘরের লোকের মন্দ-আশংকায় সে বড় করুণ ।

সাজানো-গোছানো আর সারল্যের ছবি রাশি রাশি
ফোটে তার যত্নে গড়া সংসারের আনাচে-কানাচে,
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর এ ব্যাপারে খ্যাতি;
কর্মঠ পুরুষ সেই সংসারের চতুষ্পার্শ্বে আছে ।

 

এইতো আমার দেশ

হেমন্তের মিঠে রোদ মমতা ছড়িয়ে দেয় কোশাখালি গ্রামে
পঁচিশ ত্রিশ আর তারো বেশি বছর কেটে গেলেও যেন
মেটে না মনের সাধ বাঁশ আম কাঠাল বাগানে সাঁঝ নামে
হাঁসগুলো ঘরে ফেরে, বুকের ভেতরে এই ব্যাকুলতা কেন
অঘ্রাণের ধুলোর পথের পাশে বেড়ে ওঠে ঘাসের দেয়াল
নূপুর কোমল মুঠো মুঠো পাখি এখানে ওখানে মিঠে পানি
হায়রে ফুরিয়ে এলো সব রোদ সহসাই হলো যে খেয়াল
এই তো আমার দেশ কখন সোনা ছড়ায় চারদিকে জানি।
রূপপুরে বাউই কোলায় আড়ানিতে চর সিঁন্দুরে খলিল
রহিমা রজব আশালতা আর মাধব বৈরাগীর ঘর
রয়েছে গাছের নিবিড়তা নিয়ে উঠানে চাঁদের খিলখিল
আমার ছেড়ে যাবার কথা হলে আমি হই অমনি কাতর।
হায়রে সুন্দর শুভ্র উড়ে আসে জলাটিতে-সবুজে হারায়
কুয়াশা হিমেল সুখ শিশিরের রূপময় এই বাংলায়

 

স্বাধীন আবাস ভূমি

শালিক বুলবুলির স্বাধীন আবাস ভূমি সবুজ শহর
ভোর হতে না হতেই ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যায় সুখী স্বাধীনতা
সারা দিন সুরে সুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে পাখিদের কথা
সবচেয়ে ছোট পাখি কোথায় টুনটুনির গোপনীয় ঘর
রেহানা হামিদা ঊষা সাজায় গেরস্থালি আরো দিনভর
নারী তার ঝাঁটা হাতে চারদিকে আনে ঝকঝকে কোমলতা
থালায় গরম ভাত ধোঁয়া ওঠা এনে দেয় বাঁচার ক্ষমতা
শেফালি ফুলের মতো চাঁদ তারা কখনো ফোটায় ওষ্ঠাধার
কমলা রঙের রোদ মুছে যায় খয়েরি চিলের ডানা থেকে
বেড়ায় শুকাতে দেয়া শাড়িখানা ঘরে নেয় সাঝ হলে নারী
ঘরের কোণায় আরো জ্বেলে দেয় সাবধানে কেরোসিন বাতি
শাক ভাজে মাছ রাঁধে মাটির চুলোর পরে কড়াইটা রেখে
হেঁসেলে সাজানো আছে রমণীর রমণীর অনেক জিনিস দরকারি
গাছের আঁধারে আছে গাঢ ঘুম না থাক দুয়ারে বাঁধা হাতি..

 

আমি কিন্তু যামুগা

আমি কিন্তু যামুগা। আমারে যদি বেশি ঠাট্টা করো।
হুঁ, আমারে চেতাইলে তোমার লগে আমি থাকমু না।
আমারে যতই কও তোতাপাখি, চান, মণি, সোনা।
আমারে খারাপ কথা কও ক্যান, চুল টেনে ধরো।

আমারে ভ্যাংচাও ক্যান, আমি বুঝি কথা জানিনাকো।
আমার একটি কথা নিয়ে তুমি অনেক বানাও।
তুমি বড় দুষ্টু, তুমি আমারে চেতায়ে সুখ পাও,
অভিমানে কাঁদি, তুমি তখন আনন্দে হাসতে থাকো।

শোবোনা তোমার সঙ্গে, আমি শোবো অন্যখানে যেয়ে
আর এ রাইতে তুমি শুয়ে রবে একা বিছানায়,
দেখুম ক্যামন তুমি সুখী হও আমারে না পেয়ে,
না, আমি, এখনি যাইতেছি চলে অন্য কামরায়।

 

এখন পালাও দেখি

এখন পালাও দেখি! বন্ধ করে দিয়েছি দরোজা!
এ রাত্রিতে, আমার দু’হাত থেকে পারো না পালাতে।
বরং সেটাই মেনে নেওয়া ভালো, যা নির্ঘাত সোজা।
আমার আলিঙ্গনে বেঁধে থাকো এ সুন্দর রাতে।

মিছেমিছি কেন তুমি রাগ করে চলে যেতে চাও!
বেশ তো, আমার সাথে আজ রাতে কথা বলবে না।
হয়েছে তোমার রাগ, আলাদা কি হবে বিছানা?
অন্যখানে শুতে যাবে, কিছুতেই হবে না, হবে না!

চামেলী, মালতী আর রজনীগন্ধার সুরভিতে
তোমার বিত্ত্বল দেহ, সে সুরভি সারা ঘরময়,
আর সে সুরভি যেন কেঁপে ওঠে তোমার নীবীতে।
রাত্রিতে তোমাকে ছেড়ে একা থাকা…বড় কষ্ট হয়!

হে অভিমানিনী, আমি অসহায়, বড়ই কাতর,
প্রেয়সী, মিষ্টি হেসে ক্ষমা করো, তুমি নও পর।

 

দুঃস্বপ্ন

এখন ঘুমের মধ্যে মুখ দিয়ে কথা বের হয় না
ভয়ে গোঙাতে থাকি আঁ আঁ করে;
মনে হয়, ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছি
আমাকে ধরতে আসছে বন্দুকধারীরা,
চিৎকার করতে যাই অ্যাপাচি অ্যাপাচি
কিন্তু কথা বের হয় না মুখ দিয়ে
শুধু গোঙাতে থাকি আঁ আঁ করে
হুইটজার কামান থেকে গোলা ছুড়ছে খুনিরা
বর্ডারের ওপার থেকে জবাব দিচ্ছে প্রতিপক্ষ,
ঊর্ধ্বশ্বাসে যেদিকে পারি দৌড়াচ্ছি—
আরও লোক আরও নরনারী প্রাণ নিয়ে;
হঠাৎ দেখি বিশাল শরীরের দুটো লাশ কুকুরে খাচ্ছে
মনে হলো, বিদেশি সৈন্য
তাদের হাড় মড় মড় করে চিবোচ্ছে কুকুর
ভেড়ামারা কলেজের উত্তর দিকে প্রস্রাবখানার দেয়াল
রাইফেলের গুলিতে ছিদ্র হয়ে আছে
যেমন দেখেছিলাম পাবনা জনতা ব্যাংকের…
নারকীয় পাবনা শহর…লাশ আর ছড়ানো ছিটানো
ট্রেসার লাইটে
ইউনিফর্ম পরা লাশগুলো ভেসে যাচ্ছে পদ্মা নদীর স্রোতে
দক্ষিণ দিকে…

 

সময়

সময় তো চলে যায়, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন
শেষ হয় তীরে গিয়ে, জীবন ফুরিয়ে যায় ঠিক
এখনি যখন প্রতি মুহূর্তের অতীতে গমন;
নতুন মুহূর্ত ফের জন্ম নেয়, সুখের দিকে
যায় যেন মরণের দিকে কোনো নতুন অতীতে।
যেমন একটি ফের সূর্যোদয় থেকে ক্রমাগত
সন্ধ্যার চরম কোণে যেতে থাকে মৃত্যু ছুঁয়ে নিতে,
রাতের আঁধাররেখা স্পর্শ করে সূর্য হয় গত।

আমারও প্রাণের আয়ু শেষ হয়ে যেতেছে তাহলে,
একটি নিশ্বাস থেকে মনে হয় আরেক নিশ্বাসে
আমিও যেতেছি কমে; যে রকম ধীরে ধীরে গলে
মোমের প্রদীপ জ্বলে আগুনের উত্তাপে, বাতাসে।
তাহলে, কী হবে, যদি আমারও সময় শেষ হয়,
কী হবে, হে প্রভু, পাব সে মুহূর্তে তোমার আশ্রয়?

 

বৈশাখে তোমাকে ভালোবাসি

বৈশাখে আবার আমি তোমাকে ভালোবাসি।
স্বপ্নে চলে যাই আমার সুদূর ভেনিসে,
গণ্ডোলায় বসি মুখোমুখি সারারাত,
ধুয়ে যাচ্ছে পৃথিবী জ্যোৎস্নায়
ধুয়ে যাচ্ছি তুমি আর আমি।
ফিরে আসি, আবার আমরা ফিরে আসি চট্টগ্রামে,
কর্ণফুলীতে খুলে দিই একটি নতুন সাম্পান,
বৈঠা আমার হাতে আর তুমি দুটো হাত
রেখেছো আমার দুই কাঁধে,
বাতাসে তোমার রাত্রি কালোচুলের বিপুল সুগন্ধ।
যুগল চাঁদের ছবি খুলে যায়
তোমার বুকে।

বৈশাখের চাঁদ মুখ টিপে হাসে আমাদের
দুজনের মাথার উপরে।
তুমি আমার গান, তুমি আমার সুমধুর সুর,
তোমার ভালোবাসার ফিসফিস কথাগুলো
একবার গণ্ডোলায় একবার সাম্পানের পাটাতনে,
পানির সিম্ফনিতে কী যে মিষ্টি বেজে ওঠে,
জার্মানির বেটোফেন এই সুর সৃষ্টি করেছেন।
চাকমা ইটালিয় যুবতীর খিলখিল হাসি।

বৈশাখে তোমাকে আমি ধুয়ে মুছে
সাফ সুতরো করে
আবার নতুন করে ভালোবাসি।
আবার আমাদের ভালোবাসা শুরু করি
নতুন বঙ্গাব্দে,
কালবৈশাখী যাতে আমাদের এই ভালোবাসা
ভেঙে না ফেলে, যাতে উড়িয়ে না-নেয়, উপড়ে না-ফেলে,
আমরা নতুন খুঁটি লাগাই আমাদের ভালোবাসার চারপাশে।

শেষ পর্যন্ত চাঁদ ডুবে যাবে, নক্ষত্র ডুববে আকাশে,
ভালোবাসার সাম্পান গণ্ডোলা ডুববে না।
এই শুভ কামনায় তোমার ঠোঁটের মিষ্টি
আমার দু’ঠোঁটে।

 

কবিতা ঝরে বৃষ্টি ঝরে

কবিতা ঝর ঝর করে ঝরে, সাদা নুড়ির মতো ঝর্ণা
টিএস এলিয়ট, মালার্মে, রবীন্দ্রনাথ, ওমর আলীর হাতের ওপরে কবিতা ঝরে বৃষ্টি ঝরে
কবিতা মনের মধ্যে এক খণ্ড সীমানা চৌহদ্দির জমির ওপরে
ঝরে যায় বহুক্ষণ ঝরে যায় বৃষ্টি
ওপরে মেঘ বিজলির চমক বজ্রপাত হতে থাকে
বিরহী যক্ষ কৈলাসগিরি থেকে মেঘদূত প্রেরণ করেন প্রিয়ার উদ্দেশে
আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে
কবিতা ঝর ঝর করে ঝরে শিশির মুক্তা হোমারের মনের ওপর
অন্ধ হোমার গেয়ে যান ইলিয়াড ও ওডিসি
সুন্দরী হেলেনকে নিয়ে যান প্যারিস প্রিয়ামের পুত্র
ট্রয়ের যুদ্ধ হয় কাঠের ঘোড়া তৈরি হয় হেক্টর মারা যান
অ্যাকিলিস মারা যান
পৃথিবী কোটি কোটি বছর ঘুরতে থাকে নিয়মমতো
এক মুহূর্তের জন্যও থামে না।
মানুষের জন্ম হয় মৃত্যু হয় কবি স্যাফোর জন্ম-মৃত্যু হয়
খলিল জিবরানের জন্ম-মৃত্যু হয়
কবিতা ঝর ঝর করে ঝরে শাদা নুড়ির মতো ঝর্ণা
টিএস এলিয়ট, মালার্মে, র্যাঁবো, বোদলেয়র, রবীন্দ্রনাথ,
কালিদাস, ওমর আলীর হাতের ওপর
কবিতা ঝরে… বৃষ্টি ঝরে…


ওমর আলী
কবি।

যে দুটি গান থেকে অঞ্জন দত্তের ‘বেলা বোস’ ও কাঞ্চনজঙ্ঘা’

আমাদের শৈশব ও গ্রামের সংস্কৃতি

Leave a Reply