তালাশ তালুকদার
মধ্যরাত হলে কে শোনেননি শেয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক? কে দেখেননি অন্ধকার রাতে সারি সারি জোনাকিদের? হ্যারিকেনের মিটমিটে আলোয় কে স্কুলের পড়া পড়েননি? আলুর জমিতে গরুর হাল জুড়িয়ে দিয়ে আলু কুড়ানোর জন্য চটের ব্যাগ হাতে কে ঘোরেনি গরুর হালের পিছে পিছে? কিংবা ধানকাটা হয়ে গেলে ধানের জমিতে ইদুরের গর্তে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ইদুরের নিয়ে যাওয়া ধান গর্ত থেকে টেনে বের করেনি কে? ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর টর্চ লাইট জ্বেলে নদীতে মাছ ধরতে যায়নি কে? দলবেঁধে নদীতে সাঁতার কাঁটা, হাডুডু খেলা, চোর, ডাকাত, পুলিশ খেলা কে খেলেনি?
অন্তত যারা আশির দশক এবং নব্বই দশকের প্রথমভাগে গ্রামে বড় হয়েছে, গ্রামে থেকেছে তাদের কাছে এমন দৃশ্য খুব চেনা হওয়ার কথা।
জ্বি, আমি আশি কিংবা নব্বই দশকের কথাই বলছি।

ছবি: নেট থেকে সংগৃহিত।
সময় কিভাবে দ্রুত চলে যায়, যাচ্ছে, তা ভেবে অবাক হই। দ্রুত পুঁজির বিকাশের কারণে আজ থেকে ত্রিশ বছর আগের পাড়ি দেওয়া সময়টাকেও এখন বেশ অচেনা লাগে। আজকে গ্রামে গ্রামে ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। অর্থ্যাৎ নাগরিক সুযোগ সুবিধার অনেক কিছুই গ্রামের মানুষের কাছে ধরাও দিয়েছে। অথচ এই তো সেদিনের আশির দশক কিংবা নব্বই দশকের শেষের দিকেও গ্রামের ভিতর দিয়ে কোনো মোটরসাইকেল যাওয়া কত বড় ঘটনা ছিল। আজকের সময়ে এমন কথা বললে তো অনেকে ইউটোপিয়া ভাববে। অথচ সে সময় গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাওয়া সেই মোটরসাইকেল দেখার জন্য বাড়ির ভিতর থেকে দৌঁড়ে বের হয়েছে ছেলেমেয়েরা। আমার এখনো স্মরণে আছে, হোন্ডা চলে যাওয়ার পর হোন্ডার ধোঁয়া শুঁকার জন্য মাটির উপর নাক দিয়ে রাখতো কচি কচি ছেলেমেয়েরা যাতে ডিজেল চালিত ধোঁয়ার ঘ্রাণ উপভোগ করতে পারে।
মধ্যরাত হলে কে শোনেননি শেয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক? কে দেখেননি অন্ধকার রাতে সারি সারি জোনাকিদের? হ্যারিকেনের মিটমিটে কে আলোয় কে স্কুলের পড়া পড়েননি? আলুর জমিতে গরুর হাল জুড়িয়ে দিয়ে আলু কুড়ানোর জন্য চটের ব্যাগ হাতে কে ঘোরেনি গরুর হালের পিছে পিছে? কিংবা ধানকাটা হয়ে গেলে ধানের জমিতে ইদুরের গর্তে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ইদুরের নিয়ে যাওয়া ধান গর্ত থেকে টেনে বের করেনি কে? ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর টর্চ লাইট জ্বেলে নদীতে মাছ ধরতে যায়নি কে? দলবেঁধে নদীতে সাঁতার কাঁটা, হাডুডু খেলা, চোর, ডাকাত, পুলিশ খেলা কে খেলেনি?
সেসময় গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি ছিলোনা। ফলে, ঘর আলোকিত করার মাধ্যম হিসেবে হ্যারিকেন, নয়তো চেরাগই ছিল ভরসা। আট আনা কিংবা এক টাকায় অনেক কেরোসিন তেল পাওয়া যেতো। যা দিয়ে সারারাত হ্যারিকেন কিংবা চেরাগ জ্বালিয়ে রাখা যেতো। ইলেক্ট্রিক ব্যবস্থা না থাকার দরুণ টিভি ফ্যান কিছুই ছিলোনা।

ছবি: নেট থেকে সংগৃহিত।
অনেকের মনে থাকবার কথা, আলিফ লায়লা, সিন্দাবাদ কিংবা বিশেষ কিছু টিভি সিরিয়াল দেখার জন্য কারো কারো বাড়িতে আগেই গিয়ে বসে থাকা লাগতো। টিভি দেখতে এত লোকের সমাগম হতো যে, টিভি বাড়ির উঠানে সেট করতে হতো। সবার বাড়িতে টিভি থাকতোনা। পুরা গ্রাম মিলে দুই একটা অর্থনৈতিকভাবে উর্ধ্বমুখী ফ্যামিলিতে টিভি থাকতো শুধুমাত্র। তাও আবার সাদাকালো টিভি। পরিস্কার দেখা যেতোনা, সবসময় ঝিঁরঝিঁর করতো। এন্টেনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টিভির স্ক্রিন ক্লিয়ার করা লাগতো।
গ্রামের আশেপাশে সিনেমা দেখার কোনো হল ছিলনা। সিনেমা দেখতে হলে শহরে গিয়ে দেখতে হতো। এইসব হলগুলোতে টিকিট আগেই ব্ল্যাকে বিক্রি হয়ে যেতো; একারণে গ্রামের সাধারণ ছেলেরা শহরে যেতো কম। এছাড়া হলগুলোতে টিকিট কাটা নিয়ে প্রায়ই মারামারি হতো। ফলে, গ্রামের সহজ সরল উঠতি ছেলেদের পক্ষে মারপিট করে টিকিট কেটে সিনেমা দেখা বেশ কঠিনই হয়ে পড়তো। একারণে গ্রামের ছেলেরা ঐসব সিনেমাগুলো দেখতো ভিসিআরে। সবাই মিলে চাঁদা তুলে ভিসিআর, টিভি ভাড়া করে আনতো। ব্যাটারি দিয়ে চালানো লাগতো সেসব।

ছবি: নেট থেকে সংগৃহিত।
গ্রামে গঞ্জে বিভিন্ন উপলক্ষ্য করে মেলা বসতো প্রায়ই। সে মেলাগুলোতে নানাপদের মিষ্টির দোকান বসতো। আমার মনে আছে, মিষ্টির দোকানগুলোতে বড় বড় মিষ্টি পাওয়া যেতো। সেসব মাছাকৃতি মিষ্টির একেকটার ওজন এক থেকে দেড়, দুই কেজি পর্যন্ত হতো। একটা মিষ্টি কিনলে চারপাঁচজন মিলেও খাওয়া সম্ভব হতোনা। এছাড়া সন্দেশ, বাতাসা, জিলাপী, নিমকী সহ হরেকরকমের মিষ্টান্ন পাওয়া যেতো।
মেলার প্রধান আকর্ষণ ছিল যাত্রাপালা। কি সুন্দর সেসব যাত্রা। দি রওশন সার্কাস, সোনার বাংলা সার্কাস এইসব দলের শো শুরু হতো সন্ধ্যার পর থেকে। মানুষেরা সারারাত যাত্রা দেখে ভোরে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে ফিরতো ঘরে। যাত্রাপালার কর্তৃপক্ষ ঢাকা থেকে নায়ক নায়িকাদের ভাড়া করে আনতো। তাদেরকে একনজর দেখার জন্য লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়তো। এছাড়াও হাতির ফুটবল খেলা, মেয়েদের রিং খেলা আর জোকারের জোকারিতে মুর্হুমুহু করতালিতে প্যান্ডেল প্রকম্পিত হতো।
ছেলেমেয়েদের মনোরঞ্জনের জন্য মেলায় সবকিছুই ছিল। চড়কি খেলা থাকতো। পুতুলনাচ হতো। হোন্ডা খেলা থাকতো। যে হোন্ডা খেলা দেখাতো সে খুব স্প্রিডে গভীর কূপের ভেতরে হোন্ডা নিয়ে ঘুরতে থাকতো। মনে হয়, এই বুঝি পড়ে যায় যায় অবস্থা। কখনো কখনো হাত ছেড়ে দিয়ে কখনো হোন্ডার উপরে শুয়ে হোন্ডা চালাতে দেখে আনন্দ পেতাম খুবই; সঙ্গে সঙ্গে হোন্ডা চালকের একটু উনিশ বিশ হলেই পরিণতি কি হবে ভেবে বিস্ময়ে গা শিঁউরে উঠতো। পরে জেনেছি, সবই প্র্যাকটিস; প্র্যাকটিসের ভেতর থাকলে সব কিছুই সম্ভব হয়ে উঠে এক সময়।
মেলায় চুড়ি ফিতার দোকান বসতো। সেই দোকানগুলোতে যাবতীয় খেলনা পাওয়া যেতো। ছেলেরা পিস্তল কিনতো। পিস্তলগুলো ছিল টিনের। আংটাতে বারুদ দেওয়া লাগতো। ট্রিগারে চাপ দিলেই বারুদ ফুটে ধোঁয়া উড়তো সাথে সাথে আওয়াজও হতো। আরেকটা প্রিয় খেলনা ছিল, সেই খেলনার নাম টমটম গাড়ি। কোথাও কোথাও বিশেষত বগুড়া অঞ্চলগুলোতে এই বিশেষ খেলনাটিকে ডড্ডোরি নামেও ডাকা হতো। অদ্ভুত সেই খেলনা। দড়ি ধরে টেনে নিয়ে যেতে হয়। টেনে নিয়ে গেলে অটোমেটিকভাবে ঢোলকের মতো বাজতে থাকে। আরো কত খেলনা ছিল; সেসব খেলনা না পেলে মাটিতে গড়াগড়ি খেতো শিশুরা। বাধ্য হয়ে কিনে দিতে বাধ্য হতো অভিভাবকেরা।
শৈশবে অনেকের ঘুড়ি উড়ানো পছন্দ করতো। উন্মক্ত মাঠে কিংবা ফসলতোলা জমির ভেতর বসে নানাপ্রকারের ঘুড়ি, চঙ উড়াতো কিশোর কিশোরীরা। অনেকে মার্বেল খেলতো। মনে পড়ে মার্বেল খেলে কৌটা ভরে রাখতাম। সাইকেলের পরিত্যক্ত টায়ার দিয়ে খেলতাম। খুব মনে পড়ে, কোনো পুরোনা টায়ারকে চাকা বানিয়ে একটা কঞ্চি দিয়ে তেড়ে নিয়ে যেতাম আর টায়ারের সাথে সাথে নিজেও দৌড়াতাম।
ছেলেবেলার তিনচাকার গাড়ি মানে বেয়ারিং গাড়ির কথা সকলেরই মনে থাকার কথা। এই বেয়ারিং গাড়ি বানাতে বাঁশ, কাঠ আর তিনটা পরিত্যক্ত বেয়ারিং লাগতো শুধু। আমরা নিজেরাই তৈরি করতে পারতাম। অনেকের বাড়িতে সাইকেল, ভ্যান কিংবা রিক্সার পরিত্যক্ত বেয়ারিং থাকতোই। সেসব সংগ্রহ করে গাড়ি বানাতাম। গাড়ির উপর বসে থাকতো একজন। আর একজন পিছন থেকে ঠেলা দিতে হতো আর হরহর করে দ্রুতবেগে গাড়ি চলতো। এছাড়াও লাটিম ঘোরানো খেলা, কুতকুত খেলা, গোল্লাছুট খেলা সহ নানাধরণের খেলা হতো শৈশবে।

ছবি: নেট থেকে সংগৃহিত।
আমরা অষ, কষ, সিঙ্গারা, বুলবুলি, মসকট খেলতাম। কলার পাতা দিয়ে ঘর বানিয়ে খেলাঘর তৈরি করতাম। সেইখানে ছোট হেঁশেল বানিয়ে ছোট ছোট পাতিলে বালু রান্না করতাম। মিছেমিছেই সবজি বানাতাম। সেসব মুখে না দিয়েই মুখ নেড়ে নেড়ে খাওয়ার ভঙ্গি করে খাওয়া শেষ করতাম। বৌ, স্বামী খেলতাম। মেয়েরা বউ হতো, ছেলেরা স্বামী হতো। একটা সংসার করতাম। অবশ্য মাগরিবের আজান দিলেই সেই সংসার ভেঙ্গে আসল ঘরে আসা লাগতো।
শৈশব মানেই হলো নির্ভার হয়ে থাকা। মাথায় অর্থনীতির বোঝা নাই। সংসার চালানোর দায় নাই। বোঝাপড়ার হিসাব নাই। লোভ, হিংসা কিংবা লালসার জায়গা নাই। ফলে এখানে কে ব্রাক্ষ্মণ কে মুচি কে তালুকদার কে প্রামানিক সেসবের কোনো বালাই ছিলনা। ফলে, ঈদ, পুজা কিংবা অন্যান্য উৎসবে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বাড়িতেই নির্দ্বিধায় যাতায়াত ছিল।
আমাদের সময়ে অর্থ্যাৎ শৈশবের সময়ে কারো বিয়ের অনুষ্ঠান হলে বিয়ের দুইতিনদিন আগে থেকে বিয়ে বাড়িতে ধূম পড়ে যেতো। বিয়ের দুই তিন রাত আগে থেকেই বিয়ে বাড়িতে গীত গাওয়া হতো। পাড়ার যে সমস্ত ভাবি, চাচীরা ভাল গীত গাইতে পারতো, ভাল নাচতে পারতো, তাদেরকে বিয়েতে গীত গাওয়ার জন্য আগে থেকেই বলে আসা লাগতো। তাদের জন্য এক্সাট্রাভাবে পান, সুপারীর ব্যবস্থা করা লাগতো। তারা মুখ পুড়ে পান খেতো আর গীত গাইতো। কখনো কখনো মাথায় কাপড় দিয়ে কোমড় দুলিয়ে দুলিয়ে নাচতো। এই গীত গাওয়া এবং নাচা প্রায় মধ্যরাত অবধি চলতো। কখনো কখনো মধ্যরাত পেরিয়ে ভোর পর্যন্ত চলতো।
সেই সময় বিয়েতে যৌতুক হিসেবে ছেলেদেরকে কেউ কেউ ফনিক্স সাইকেল, রেডিও কিংবা হাতঘড়ি দিতো। বরযাত্রীর যানবাহন হিসেবে দেখা যেতো বেবিট্যাক্সি কিংবা পায়ে ঠেলা রিক্সা। আমার খুবই মনে আছে, বিয়ের পর পাঁচ কুটুমের সময়ে বিবাহিত বউকে রিক্সায় নয়তো গরুর গাড়িতে করে আনতো। এবং সে রিক্সা কিংবা গরুর গাড়িখানা কখনোই উন্মুক্ত ছিলোনা। গাড়ির চতুর্দিকে ঢাকা তো থাকতোই পাশাপাশি দশ হাতের শাড়ি দিয়ে গরুর গাড়ি কিংবা রিক্সার সম্মুখ ভাগও পেঁচানো থাকতো। বাড়িতে নতুন বউ এলে পুরো গ্রামজুড়ে হৈ হুল্লোড় পড়ে যেতো। সবাই দলবেঁধে বাড়িতে আসতো নতুন বউ দেখতে। হায়, সেসব সংস্কৃতি এখন কোথায়?
গ্রামীণ জীবনের সেই চিরচেনা সংস্কৃতি এখন আর দেখাই যায়না প্রায়। গ্রামীণ জীবনেও এসেছে পরিবর্তন। শহুরের মতো গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও পশ্চিমা কৃষ্টিকালচারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে দিন দিন; আর ভুলে যেতে বসেছে নিজস্ব সংস্কৃতিকে।

Leave a Reply