তালাশ তালুকদার
কেউ হারিয়ে গেছে? যাও মুন্সি, মৌলভীর কাছে। মুন্সি মৌলভীর পানি পড়া খাও। জ্বর হয়েছে? রাতে ঘুম হচ্ছেনা? বাচ্চাটি কানতেছে? তাহলেও মুন্সি, মৌলভীর কাছে যাও, তারা দোয়া দরুদ পাঠ করে বুকে ফুঁ দিলেই সব মুসকিল আসান হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, বহু সমস্যারই সমাধান দেয় এই মুন্সি মৌলভীরা। যেমন, কারো বয়স হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিবাহ হচ্ছেনা। গ্রামে জনশ্রুতি আছে, যাদের বয়স হয়ে যাওয়ার পরও বিয়ে হয়না কিংবা চেষ্টা করার পরও বিয়ে হচ্ছেনা। তখন গ্রামের লোকেরা তাদেরকে বলে বিয়ে হচ্ছেনা যেহেতু সেহেতু কেউ না কেউ তোমার শত্রু জাতীয় কেউ আঁচলি (তাবিজ) করে রেখেছে। তো, তারাও যায় এইসব মুনসি, মৌলভী কিংবা কবিরাজের কাছে। গিয়ে আঁচলি কেটে নিয়ে আসে। কারো বাড়ির আঙ্গিনায় তাবিজ পোঁতা থাকলে জ্বীনের মাধ্যমে তাবিজ তুলে নেয়। পরবর্তীতে দেখা যায় তার বিবাহ হয়ে যাচ্ছে।
আবার কারো বিয়ে হয়েছে কিন্তু বাচ্চা হচ্ছেনা। তারাও স্মরাণাপন্ন হয় এইসব বুজুর্গদের কাছে। কেউ মাজারে মানত পর্যন্ত করে। ইয়া আল্লাহ আমার যদি ছেলে সন্তান হয় তাহলে মাজারে খাসি জবেহ করে পোলা করে খাওয়াবো। তো বাচ্চা হওয়ার আগেই মাজারে যায় সেসব ভুক্তভোগীরা। মাজারে গিয়ে কান্নাকাটি করে, দোয়া চায় হুজুরদের কাছে থেকে। হুজুরেরা দোয়া করে দেয়। পানি পড়া দেয় আরো বিভিন্ন রকমের তাবিজ দেয়। যা হাতে কিংবা কোমড়ে বেঁধে রাখতে হয়।
একবার একটা মেয়ে তার প্রেমিকের কাছে ছুটে আসে। সে কোন বাধাই মানে না, মানতে চায়না। জমির আল ডেঙ্গে, কাঁচা রাস্তা, ডোবা নালা পেরিয়ে, পড়নে যে জামা পড়া থাকে সে জামা পড়েই ছুটে আসে প্রেমিকের বাড়িতে। প্রেমিকা নাছোড়বান্দা। প্রেমিককে সে বিয়ে করবেই। কোন বাঁধাই তাকে আটকাতে পারছেনা। সে প্রেমিককে নিয়ে পালিয়ে যায়। এসমস্ত লক্ষণ দেখা দিলে লোকেরা বলে, এই মেয়েটিকে নিশ্চিত বাণ মারা হয়েছে। নইলে কিভাবে সে ছুটে আসছে এত দূর থেকে।
গ্রামে এরকম বহু ঘটনা আছে যে ঘটনার দিকে তাকালে অলৌকিক মনে হবে। কেউ অস্বাভাবিক আচরণ করলে তাকে জ্বীনের কাছে নিয়ে যায় লোকেরা। জ্বীনের থেকে পানি পড়া খেলে দেখা যাবে বেশ ভাল হয়ে উঠছে।
যাকে জ্বীনে ধরেছে সে লোকের কাছে কেউ যদি পরীক্ষামূলক বলে যে, মেলায় থেকে কিছু খাবার এনে দিতে। সে খাবার এনে দেয়। লোকেরা আশ্চর্য্য হয়। কিভাবে সম্ভব? সত্যি সত্যিই জ্বীন আছে কিনা তা প্রমাণ করতে কোন কোন ব্যক্তি আরো প্রমাণ পেতে চায়। সেজন্য কেউ কেউ বলে, তুমি (জ্বীন) যে এখান থেকে উড়ে যাবে তার প্রমাণ স্বরূপ কোন না কোনো গাছের ডাল ভেঙ্গে দেখিয়ে দিয়ে যাও যে, তুমি সত্যি সত্যিই উড়ে যাচ্ছো! তখন পাশের গাছ থেকে হুট করে গাছের ছোট্ট একটা ডাল ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে। তখন লোকেরা বিশ্বাস করে যে, জ্বীনটা সত্যি সত্যি উড়ে গেল। তখন মানুষেরা আরো আশ্চর্য্য হয়। এসব যারা দেখে থাকে তারা বিম্মিত হয়ে আরো বিশ্বাস স্থাপন করে। কথা হলো, এসব আমি বা আমরা কেউ না কেউ না দেখলেও কেউ না কেউ দেখে থাকে। এসব অলৌকিক কিছু যারা দেখে তারা কিভাবে অবিশ্বাস করবে।
একবার একটা ছেলে বাবা মায়ের উপর রাগ করে গ্রাম থেকে চলে গেল। অনেক দিন পার হয়ে গেলেও যখন আসছেনা তখন হারিয়ে যাওয়া ছেলেটিকে খুঁজে পেতে গ্রামের ঝাড়ফুক দেওয়া মুন্সি, মৌলভীর কাছে যায়। তারা সমাধান হিসেবে ঝাড় ফুক পানি পড়া দেয়। এতেও কাজ না হলে সেসব মুন্সি মৌলভীরা জ্বীন পরীদের হাজির করে সমাধান নেয়। গ্রামের মানুষেরা বিশ্বাস করে কোন ব্যক্তি সমাধান করে দিতে না পারলেও জ্বীন পরীরা সমাধান দিতে পারবে। এগুলো মানুষের বিশ্বাস। লোকজনের কাছে সে বিশ্বাস পুরোদমে স্থাপনের জন্য জ্বীনেরা আবার আয়নার ভেতরেও দেখাতে চায় সে হারিয়ে ছেলেটিকে। তখন বিশ্বাস না করে আর উপায় কি। লোকের বিশ্বাস জ্বীনের কাছে থেকে আয়নাপড়া পেলেই ছেলেটি ফিরে আসবে। এজন্য জ্বীন রূপে যে মানুষটি হাজির থাকে সে যেটাই ডিমান্ড করে সেটাই সহজ সরল লোকেরা দিয়ে দেয়। যদি বলে, মানত করতে হবে, নগদ টাকা দিতে হবে তাই দেয়। অর্থ্যাৎ জ্বীন রূপী মানুষটি যদি বলে, বাড়ির চারপাশে তাবিজ পুঁতে রাখতে হবে, লোকেরা সেটাও করে। শ্মশানঘাট থেকে মাটি ও পানি নিয়ে এসে ঘরে ও ঘরের উঠানে ছিটাতে থাকে। একটা কোকিল পাখির ধরে নিয়ে এসে তার পায়ে তাবিজ দিয়ে উড়ে দেয়। গাছে গাছে তাবিজ ঝুলায়ে দেয়। জ্বীন বলে, গাছের ডালে থাকা তাবিজ বাতাসে নড়লেই হারিয়ে যাওয়া ছেলেটির বাবা মা এবং পরিবারের কথা মনে হবে তখন আর সে উক্ত জায়গায় থাকবে পারবেনা, বাড়িতে আসার জন্য ছটফট করতে থাকবে। এভাবে চলতেই থাকে। চলতে চলতে একদিন হারিয়ে যাওয়া ছেলেটি আবার ফিরেও আসে।
কেউ প্রেম করতে চাইছেনা মানে, প্রেমে রাজি হচ্ছেনা তাহলে তার ব্যবহৃত জামা চুরি করে এনে সেই জামার উপর আরবী অক্ষর লিখে তাবিজ করে। কিংবা মুন্সির থেকে মিষ্টি পড়া এনে খাওয়াও তাহলে প্রেম হয়ে যাবে। সংসারে স্বামী স্ত্রীর বনিবনা হয়না তাহলে মোনা মুনি একত্রে রেখে দাও তাহলে মিল হয়ে যাবে। সন্তানটি অসুস্থ কিংবা রোগাটে, ব্যবসায় লোকসান কিংবা কারো চাকরি হয়না, কর্মক্ষেত্রে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে, প্রেম হচ্ছেনা এসব ক্ষেত্রেও গ্রামের লোকেরা জ্বীনের পরামর্শ মোতাবেক গায়ে তাবিজ, আংটি দিয়ে সফলকাম হয়ে থাকে।
আমাদের গ্রামে করতোয়া নামক একটা নদী আছে। ছোটবেলায় দেখতাম প্রায়ই সে নদীর স্রোতে পড়ে কেউ ডুবে মরে যাচ্ছে। প্রায়ই এরকম ঘটনা ঘটতেছিল যেহেতু সেহেতু গ্রামের প্রবীণ লোকেরা বলতো, নদীতে দেও (দৈত্য) আছে। নদীতে নেমে কেউ প্রশ্রাব করলে কিংবা বেয়াদপি করলে সে দেও নদীর স্রোতে টেনে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলতো। আমার নিজেরই স্বচক্ষে দেখা এরকম একটা ঘটনা ঘটতে দেখেছি। দু’জন ছেলেমেয়ে নদীর স্রোতে হারিয়ে গেলে তাদেরকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজনকে খুঁজে পেলেও আরেকজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন ডুবুরি আনা হলো, মাছ ধরা তৌড়ো জাল দিয়ে খেও দেওয়া হলো। কিন্তু না কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা ডুবে যাওয়া মেয়েটিকে। শেষে গ্রামে এক বয়স্ক হিন্দু লোক এসে বললো, এভাবে মেয়েটিকে পাওয়া যাবেনা। মেয়েটিকে দেও (দৈত্য, পেত্নী জাতীয় কিছু) টেনে নিয়ে পানির তলে নিয়ে গিয়েছে এবং সম্ভবত কাঁদার ভেতর মুখ গুঁজে রেখেছে। এই দেও সরাতে হলে হিন্দু শাস্ত্র মতো কিছু পূঁজো করতে হবে। তাহলেই সে দেওটি মেয়েটিকে ছেড়ে দিবে। উপায়ন্তর না পেয়ে সে পুজোরই ব্যবস্থা করা হলো। নদীর দু’কূলে হাজার হাজার মানুষ তাকিয়ে থাকে করতোয়া নদীর দহর দিকে। হিন্দুরা উলুধ্বনি দিয়ে নদী তীরে বসে পুঁজা করলো। তার কিছুক্ষণ পর করতোয়ার অনেক গভীর থেকে এক ডুবুরি ডুক্কি দিয়ে তুলে আনলো ডুবে যাওয়া মৃত দেহটি।
এই নদীতে যারা রাতে মাছ মারতো তারা অনেক কিছু দেখতে পেতো। যারা গলায় দড়ি দিয়ে কিংবা বিষ খেয়ে মারা যেতো সেসব মানুষের আকৃতি ধরে নাকি ভূত, পেত্নীরা নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াতো। মেয়ে হলে তাদের পড়নে থাকতো ধবধবা সাদা শাড়ি নয়তো লাল শাড়ি। আর ছেলে হলে সাদা ধুতি কিংবা সাদা লুঙ্গি পাঞ্জাবী। কখনো কখনো কেউ রাতে বাড়ির বাইরে গেলে গ্রামের বটগাছের মাথায় আলো জ্বলা দেখতে পেতো। কখনো কখনো সে আলো বটগাছের মাথা থেকে শোঁওওত করে দুরে উড়ে গিয়ে পড়তো। লোকজন এই আলোটাকে ভূতের আলো বলতো।
অনেকে অনেক রাত হলে বাড়ি ফিরতে অনেকে সাহস পেতো না। অনেকে বলে শ্মশান ঘাট কিংবা কবরস্থানের পাশে নাকি অনেক কিছু দেখা যায়। যেমন, হঠাৎ কবরস্থানের ভেতর থেকে লম্বা, দাড়ি, টুপিপড়া মানুষ রাস্তায় বের হয়ে সালাম দেয়া। কিংবা শ্মশানঘাটে রাতের বেলায় সাদা ধূতি গাছে শুকায়ে দেওয়া। কিংবা পেছন পেছন অদৃশ্য কোনো কিছুর হাঁটতে থাকা। এই হাঁটতে থাকা লোকদের দেখা যায়না। কিন্তু পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। লোকেরা বলে, এইগুলো হলো ভাল জ্বীনের নমুনা। যাতে ঐ ব্যক্তিটির অনিষ্ট কেউ করতে না পারে তার জন্য ভাল জ্বীনেরা পাহাড়া দিয়ে দিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দেয়।
আমাদের গ্রামের লোকেরা বলে, রাতের বেলায় রাস্তায় কোনো বিড়াল কিংবা কুকুর যদি পথ আটকানোর চেষ্টা করে তাহলে সেসব প্রাণীকে যেনো পা দিয়ে আঘাত কিংবা তাড়িয়ে দেওয়া না হয়। জনশ্রুতি আছে, জ্বীন কিংবা ভুতেরা ঐসব প্রাণীর আকৃতি বেশে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে থাকে।
আমরা যখন খুবই ছোট ছিলাম, তখন শুনতে পেতাম উমুক গ্রামে উমুক হঠাৎ বড়লোক হয়ে গেছে। বড়দেরকে জিজ্ঞেস করলে, বড়রা উত্তর দিতো, তিনি টাকার ডাবর পেয়েছে। সেই লোকই নাকি জানিয়েছে, একদিন দেখে তার ঘরের মেঝে নাকি ফেটে আছে। কাউকে কিছু বলেনা। এভাবে যত দিন যায় তত ঘরের ফাটলকৃত জায়গাটা আরো বড় ফাটলে পরিণত হতে থাকে। এভাবে ফাটল বড় হতে থাকলে একদিন বাড়ির মালিক স্বপ্নে দেখে, ঐ ফাটলকৃত জায়গার নিচে টাকার ডাবর রয়েছে। জায়গা খুড়লেই টাকার ডাবর পাবো। তো, একদিন সত্যি সত্যিই ফাটলকৃত জায়গা খুড়ে টাকার ডাবর পায়। এইরকম অনেক গল্প আমরা ছোটবেলা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। ঠাকুরমার ঝুলি’র চাইতেও আমাদের ছোটবেলার গল্প, দেখা কাহিনী কম ঐশ্বর্য্যবান কি? এরকম অনেক কাহিনীই আছে যা কেবল গালগল্প হিসেবেই নয় বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্থানীয় সংস্কৃতি, সামাজিক সম্পর্ক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত যা গ্রামীণ জীবনকে প্রভাবিত করে আসছে।

                                    
                                    
                                    
                
                                
Leave a Reply