ইলিয়াস ভাইয়ের অনুবাদগ্রন্থের সংখ্যা আজ অবধি প্রায় ১৭টির মতো হবে। তাঁর বয়সী কোনো কোনো অনুবাদকের তুলনায় এই সংখ্যা হয়তো কম মনে হবে, কিন্তু গ্রন্থের গুরুত্ব এবং আয়তনের কথা যদি বিবেচনায় রাখা যায় তাহলে এই সংখ্যাটি মোটেই কম নয়, বরং অনেক বেশিই মনে হবে।
ভাবুন তো সেই গোল্ডেন বাউ নামক দানবের কথা। আমাদের ভাষায় এই প্রথমবার বইটির অনুবাদ হলো ইলিয়াস ভাইয়ের দানবীয় পরিশ্রমের ফলে। রুশোর কনফেশন নামক বিপুলাকৃতির বইটিও তিনি করেছেন অসীম ধৈর্য্য নিয়ে। কিন্তু এই সংখ্যা আর আকৃতিই মূল কথা নয়, আসল কথা হলো অনুবাদের গুণের বিষয়টি। তাঁর মতো অনন্যগুণ সম্পন্ন বাংলাদেশে তো বিরল বটেই, আমার বিবেচনায় অনুবাদের মূলানুগতা আর শৈল্পিক দক্ষতায় তিনি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের সাথে তুলনীয়।
কবিতার অনুবাদ ইলিয়াস ভাই কম করেছেন বটে, কিন্তু যখনই করেছেন, তা কাব্যস্পন্দনে যেমন, তেমনি ভাষিক লালিত্য ও ছন্দোময় আবেগ সঞ্চারণে অনন্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু আশ্চর্য্য এই যে প্রায় ৫৫ বছর ধরে এত অনুবাদ তিনি করেছেন, আমাদের লেখক সমালোচকরা তাঁর এই অসামান্য রত্নসম্ভার সম্পর্কে কেউ-ই প্রায় কিছুই লিখেননি।

অত্যন্ত গৌণ অনুবাদকদের সম্পর্কে মাঝেমধ্যে আমাদের নবীন প্রবীণ লেখকদের কথা বলতে ও লিখতে দেখেছি, কিন্তু ইলিয়াস ভাইয়ের বইগুলো নিয়ে আলোচনায় তারা নিরব। এ পর্যন্ত তিনি একটি মাত্র সরকারী/ বেসরকারী পুরস্কার পেয়েছেন, তাও অতি বিলম্বে। যে-প্রথম আলো থেকে তাঁর বই বেরিয়েছে, তারাও উপেক্ষা করেছে ইলিয়াস ভাইকে। কিন্তু ইলিয়াস ভাই এইসব উপেক্ষাকে উপেক্ষা করেই নিমগ্ন রয়েছেন সাহিত্যিক কর্তব্যবোধ থেকে। এখন তিনি অনুবাদ করছেন তাঁর প্রিয় লেখক কাজান জাকিসের বিস্ময়কর সৃষ্টি The Odyssey: A Modern Sequel, যার পংক্তি সংখ্যা ৩৩,৩৩৩। এবং এটি যেহেতু মুলে কাব্যের প্রকরণে বিন্যাস্ত, ইলিয়াস ভাই সেই প্রকরণটি অক্ষুন্ন রেখেই অনুবাদ করছেন এই মহাকাব্য।
এ হচ্ছে গৌণদের কাল যখন বীর হন উপেক্ষিত, আর খলনায়করা হন বরণীয়। আমরা ইতিহাসের সেই খল-সময়ের বাসিন্দা। কিন্তু ফ্রান্সিস ফুকায়ইয়ামার The End of the History যদি সত্য হয়, তাহলে এই খল-ইতিহাসেরও পরিসমাপ্তি আছে। এরপর শুরু হবে অন্য এক অধ্যায়। সেখানে খালিকুজ্জামান ইলিয়াস গণ্য হবেন আমাদের অনুবাদ সাহিত্যের হিরো হিসেবে।

কবি, লেখক ও অনুবাদক।
Leave a Reply